চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা
- নাজমুল হোসেন
- ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:৪৭
দেশে দিন দিন শিক্ষার হার বাড়ছে। সেই সাথে বেড়ে চলেছে বেকারত্ব। চাকরির পেছনে হন্যে হয়ে ছুটে চলেছে উচ্চ শিক্ষিত বেকারেরা। পদ খালি থাকলেও বেকারের তুলনায় চাকরির অপর্যাপ্ত পদসংখ্যা। তার সাথে মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে যুক্ত হয়েছে চাকরিতে প্রবেশে বয়সের দেয়াল। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে পুরোপুরি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিণত হতে হলে এবং এ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সের সীমাবদ্ধ প্রাচীর কতটুকু গ্রহণযোগ্য? লাখ লাখ শিক্ষার্থী পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের পড়াশোনা শেষ করেছেন ২৭ বা ২৮ বছরে। সেশন জট, রাজনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি কারণে তারা যথাসময়ে তাদের পড়াশোনা শেষ করতে না পেরে ছয়-সাত বছর পর করতে পেরেছেন। এর সাথে অনার্স ও ডিগ্রি উভয় কোর্সে বাড়তি এক বছর করে যুক্ত করা হয়েছে।
নব্বই দশকের আগে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ২৭ বছর, আর অবসরের বয়সসীমা ছিল ৫৭ বছর। তারপর গড় আয়ু আর কর্মক্ষমতার বিচার করে ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে শুধু বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়। তবে সর্বশেষ বিগত ২০১১ সালের ডিসেম্বরে শুধু অবসরের বয়স ৫৭ থেকে বাড়িয়ে সাধারণদের জন্য ৫৯ বছর আর মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৬০ বছর করা হয়। তবে এ অবসরের বয়স দৃশ্যমান কোনো দাবি-দাওয়া বা আন্দোলন ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরকার বাড়িয়েছে। একতরফাভাবে শুধু অবসরের বয়স বাড়ানোর কারণে স্বাভাবিকভাবেই শূন্যপদের সংখ্যা কমে যায়। এরপরই উপরোল্লিখিত সব কারণে চাকরির আবেদনে বয়স বাড়ানোর দাবি তুলে সারা দেশের সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও চাকরিপ্রার্থীরা। তারা ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলার প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন, প্রতীকী ফাঁসি, অনশন, সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্মারকলিপিও দিয়েছেন। সংসদেও বিষয়টি উঠেছে বহুবার।
এর সাথে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২০১২ সালে তাদের ২১তম বৈঠকে সুপারিশ করেছিল ৩২ বছরের। ২০১৬ সালে ডিসি সম্মেলনে সব জেলার ডিসিরা ৩৩ বছরের সুপারিশ করেন। ছয় বছর পর চলতি বছরের ২৭ জুন সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দ্বিতীয়বারের মতো তাদের ২৯তম বৈঠকে ৩৫ বছর করার সুপারিশ করে। যথাসময়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেয়ায় চলতি মাসের ১০ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ আবারো সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ৩৫ বছর করার জোর সুপারিশ করে এবং দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। কিন্তু তবুও আজ পর্যন্ত যে তরুণদের ভাগ্য খুলেনি! নেয়া হয়নি এর কোনো কার্যকর উদ্যোগ। আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদের সভাপতি মো: ইমতিয়াজ হোসেন ইতোমধ্যে শেষবারের মতো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হিসেবে তার প্রতিনিধিদল নিয়ে তিনি শেষবারের মতো প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদ সচিব এবং জনপ্রশাসন সচিবকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এ ছাড়াও এর দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে তারা অন্যান্য প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপিদের কাছেও ধরনা দিচ্ছেন এবং পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এ বয়সে ওই তরুণদের সংসার করার কথা, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখভাল করার কথা। অথচ তারা নিজেরাই নিজের খরচ চালাতে পারে না। এখনো তারা বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল। আবার অনেকের তো বাবা-মাও নেই। কেউ কেউ আবার পরিবারের বড় সন্তান। এ পরিস্থিতিতে তারা কোথায় যাবেন? এর উত্তর হয়তো কারো জানা নেই। বাস্তবতা এমন, এ তরুণদের অনেকেই আত্মগোপন করে থাকার চেষ্টা করেন। পরিচিত সমবয়সী বা বয়স্কদের সামনে পরলে যদি জানতে চাওয়া হয় কি করেন, সেই উত্তর দিতে পারবেন না বলে। এতে করে যে তাদের দিকে অযোগ্যতা ও মেধাহীনতার প্রশ্ন উঠে! এলাকার জুনিয়র চাকরিপ্রাপ্তদের সামনে পড়লে লজ্জা ও নীরব আর্তনাদে ভেতরটা কেঁপে উঠে। ধরে রাখতে পারেননি বাধা না মানা অশ্রু ধারাকে। কিন্তু তাদের এ বাস্তবতার বেড়াজাল সম্পর্কে কয়জন জানেন? কেউ কেউ বাধ্য হয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে দালালচক্রের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমুদ্র পথে পাড়ি দিতে গিয়ে অকালে প্রাণ দিচ্ছেন। পড়েছেন নানা সমস্যায়। কথায় আছে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু কোনো জাতিকে শুধু শিক্ষিত করে কর্মের সুযোগ না দিলে সে জাতি মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়বে। মূলত শিক্ষিত যুবসমাজ যেকোনো দেশের সম্পদ। তাদের কাজে লাগাতে হবে সমৃদ্ধ জাতি ও দেশ গঠনে। কিন্তু এমন করে কাজে লাগার সুযোগ দিতে তাদের প্রতি সরকার ও নির্ধারকদের কতটুকু ইতিবাচক দৃষ্টি রয়েছে সেটাই বিবেচ্য বিষয়।
আমাদের তরুণেরাও একটা সুযোগ চায় তাদের যোগ্যতা প্রমাণের। তারা আবেদন করবে, নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। মেধা থাকলে চাকরি পাবে, নয়তো পাবে না। তাতে সমস্যা কোথায়? তা ছাড়া বয়স বাড়ালে যে সবাই সম সুযোগ পাবে তাও কিন্তু নয়। তা ছাড়া এটা তাদের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারও বটে। এ দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২ বছর। তবে এখনো কেন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এ থমকে থাকবে? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-২০১৭ অনুসারে, এ দেশে বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ বেকার রয়েছে। তাদের বেশির ভাগই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা চাকরি প্রত্যাশী। ওই শিক্ষিত তরুণদের কর্মে প্রবেশের সুযোগ না দিলে সেটা ক্রমবর্ধমান বাড়তে থাকলে একপর্যায়ে বেকারত্বের বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা শতভাগ। অথচ চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ অবারিত করে দিলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যোগ্য প্রার্থীর অভাবে অসংখ্য শূন্য কারিগরি পদসহ প্রায় পৌনে চার লাখ শূন্যপদ সঠিক মেধাবীদের দিয়ে পূরণ হয়ে যেত।
অন্য দিকে বিভিন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, একেকটি পদের জন্য দুই-তিন বছর বা তদূর্ধ্ব অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। ২৭-২৮ বছরে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করা ছাত্রছাত্রী কিভাবে এ অভিজ্ঞতা দেখাবে? শিক্ষাগত যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা তো এক নয়। দুটোই সম্পূর্ণই ভিন্ন বিষয়। এ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তো সেই সময়টুকু থাকতে হবে। যে দেশের যুবসমাজ যত বেশি শিক্ষিত আর তদানুযায়ী কর্মক্ষেত্রে যুক্ত, সে দেশ তত বেশি উন্নত আর সমৃদ্ধশালী। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অর্জিত শিক্ষা আর সনদ থাকলেও হাতে কর্ম নেই। তা হলে আমরা কিভাবে উন্নত আর সমৃদ্ধ হওয়ার আকাশ কুসুম চিন্তা করি? অথচ আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী কর্মহীনতার যন্ত্রণায় দিশেহারা হয়ে নানা রকম অপরাধ কর্ম, মাদকাসক্ত, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি আর নিষিদ্ধ জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হচ্ছে। এ যেন তাদের কাছে অন্ধের যষ্টি। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের কাজে না লাগালে আসন্ন ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসঙ্ঘ প্রণীত ১৭টি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে চূড়ান্ত পর্যায়ের উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার পথে শতভাগ ব্যাঘাত ঘটবে।
দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিজীবীদের পদমর্যাদা অনুযায়ী পাওয়া বেতন-ভাতাদি আহামরি কিছু নয়। কারণ একটু ভালো আর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার পক্ষে এই সীমিত বেতন যথেষ্ট নয়। তাই প্রশ্ন থাকে- কেন এই সরকারি চাকরির প্রতি লোভ আর চাহিদা লাখো বেকার তরুণ-তরুণীর চোখেমুখে? উত্তরে বলা যায়- এতে সুন্দর ভবিষ্যৎ আর চাকরির শতভাগ নিশ্চয়তা নিহিত রয়েছে। রয়েছে সম্মান আর জীবনের শেষ মুহূর্তে অবসরের সময় এককালীন একটা বড় অঙ্কের সম্মানী। যা অন্য কোনো সেক্টরে নেই।
তবে সরকারের ক্ষমতার শেষ মেয়াদে এসে সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বয়স বাড়ানোর ব্যাপারে নড়েচড়ে বসেছেন। জানা যায়, বয়স বাড়ানোর এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহলে দ্বিমত রয়েছে। সরকার বিষয়টিকে নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করে আগামীতে ক্ষমতায় এসে সেটা বাস্তবায়নের কথা ভাবছে। কারণ দেশের ১০ কোটি ৪১ লাখ ভোটারের মধ্যে দুই কোটি ২৫ লাখ তরুণ রয়েছে। আর এটি তাদের দীর্ঘ দিনের দাবি। ফলে এমন প্রতিশ্রুতিতে তরুণ ভোটাররা উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে বলে ভাবছে সরকার। অতীতেও এমন পরিকল্পনার কথা বললেও এখনো তার বাস্তবায়ন হয়নি। শীর্ষ মহলের কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের আগে তরুণদের এ দাবি মেনে নিলে ভোটের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার কেউ কেউ রয়েছেন এর বিপরীত অবস্থানে। কিন্তু তরুণেরা নির্বাচনের আগেই এর বাস্তবায়ন চান।
সার্বিক দিকের উন্নয়নমুখী চিন্তাসহ শিক্ষিত তরুণদের কান্না থামাতে তাদের কর্মে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। দিতে হবে দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি। স্বপ্নের সমৃদ্ধ ও আধুনিক বাংলাদেশ নামে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে হলে এখনই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ন্যূনতম ৩৫ বছর বা তার বেশি করাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত।
লেখক : প্রকৌশলী
nazmulhussen@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা